নারী-পুরুষের শারীরিক গঠন, সক্ষমতা,
নিরাপত্তা ইত্যাদি নানা বিষয়ে যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমনি পার্থক্য রয়েছে
শরীয়তের অনেক বিষয়ে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, সতর। নারী-পুরুষ সকলের সামনেই
পুরুষের সতর হচ্ছে নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত, পক্ষান্তরে পরপুরুষের সামনে
মহিলার প্রায় পুরো শরীরই ঢেকে রাখা ফরয। নারী-পুরুষের মাঝে এরকম
পার্থক্যসম্বলিত একটি ইবাদত হচ্ছে নামায। তাকবীরে তাহরীমার জন্যে হাত
উঠানো, হাত বাধা, রুকু, সেজদা, ১ম ও শেষ বৈঠক ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে
নারী-পুরুষের নামাযের পদ্ধতিগত পার্থক্য যেমন রয়েছে, তেমনি পার্থক্য রয়েছে
নামায আদায়ের স্থান নিয়েও। নারীদের সতরের পরিমাণ যেহেতু বেশি, তাই যেভাবে
তাদের সতর বেশি রক্ষা হয় সে দিকটি বিবেচনা করা হয়েছে সর্বত্র।
সঙ্গতকারণেই
পুরুষদেরকে যখন জোরতাগিদ দেওয়া হচ্ছে মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করতে, সেখানে
নারীদের জন্যে নামাযের উত্তম স্থান বলা হচ্ছে ঘরের কোণকে। পুরুষকে উৎসাহিত
করা হয়েছে যত বড় জামাতে সম্ভব নামায আদায় করতে, আর নারীদেরকে বলা হচ্ছে
গোপন থেকে গোপনতর স্থানে নামায আদায় করার কথা। মুসলিম উম্মাহর প্রায় দেড়
হাজার বছরের অবিচ্ছিন্ন আমলের ধারা তাই প্রমাণ করে।
বিষয়টি প্রমাণিত রাসূলে কারীম সা.-এর হাদীস, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণের
ফতোয়া ও আছারের মাধ্যমেও।উল্লেখ্য, হাদীস শরীফে নারীদের মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামায আদায় করার কথাও অবশ্য বর্ণিত আছে। যেমন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, তোমরা রাতের বেলা নারীদেরকে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দাও। [বুখারি শরীফ : ৮৯৯]
বাহ্যত এ হাদীস থেকে নারীদের মসজিদে গিয়ে নামায পড়ার বিষয়টিই সাব্যস্ত হয়। রাসূলুল্লাহ সা.-এর যুগে নারীদের কেউ কেউ মসজিদের জামাতে শরিক হতেন। সেই সাথে এ হাদীসে পুরুষদেরকে নিষেধ করা হচ্ছে তাদের অধীনস্থ নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দিতে। বলা হচ্ছে, তোমরা তাদেরকে অনুমতি দাও। অপরদিকে যে হাদীসগুলোতে নারীদের মসজিদে যাওয়ার কথা আছে, সেগুলোতে যদি গভীরভাবে লক্ষ্য করা হয় তাহলে দেখা যাবে, রাসূলুল্লাহ সা. যদিও পুরুষদেরকে বলেছেন তাদের অধীনস্থ নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাধা না দিতে, কিন্তু সেসবের কোন একটিতেও তিনি তাদেরকে মসজিদে যেতে উৎসাহিত করেননি। আর আদেশ করার তো প্রশ্নই আসে না। পাশাপাশি তাদের মসজিদে যাওয়ার অনুমতিকেও করা হয়েছে শর্তসাপেক্ষ। যেমন, কোন ধরণের সুগন্ধি ব্যবহার না করা, রাতের বেলা যাওয়া, কোন ধরণের ফেতনার আশংকা না থাকা ইত্যাদি। আর হাদীস থেকে যতদূর প্রমাণিত হয়, রাসূলুল্লাহ সা. স্বয়ং নারীদেরকে মসজিদে যেতে নিরুৎসাহিত করেছেন। সহীহ ইবনে খুযায়মার হাদীসÑ ‘হযরত আবু হুমায়দ সাঈদী রা. এর স্ত্রী থেকে বর্ণিত, তিনি নবী কারীম সা.-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার সাথে নামায আদায় করতে চাই। রাসূলুল্লাহ সা. তখন বললেন, আমি তো জেনেছি, তুমি আমার সাথে নামায পড়তে চাচ্ছ। কিন্তু ঘরের কোণের নিভৃত কক্ষে নামায পড়া তোমার জন্যে ঘরের বড় কামরায় নামায পড়া থেকে উত্তম; ঘরের বড় কামরায় নামায পড়া তোমার বাড়িতে (অর্থাৎ ঘরের বাইরে কিন্তু বাড়ির ভেতরে আঙিনায়) নামায পড়া থেকে উত্তম; বাড়িতে নামায পড়া তোমার এলাকার মসজিদে নামায থেকে উত্তম; আর তোমার এলাকার মসজিদে নামায পড়া আমার এ মসজিদে তোমার নামায পড়া থেকে উত্তম। তখন তার আদেশেই তার জন্যে তার ঘরের কোণে অন্ধকার স্থানে একটি নামাযের স্থান তৈরি করা হল। আর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই নামায আদায় করলেন। [সহীহ ইবনে খুযায়মা : ১৬৮৯]
এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. উক্ত মহিলা সাহাবিকে মসজিদে যেতে নিষেধ করেননি। কিন্তু তিনি তাকে উৎসাহিত করেছেন আপন ঘরের কোণে নামায আদায় করতে। হাদীস শরীফে আছে, আমার এ মসজিদে এক রাকাত নামায মসজিদে হারাম ছাড়া অন্য যে কোন মসজিদে এক হাজার রাকাত নামাযের চেয়ে উত্তম। [সহীহ বুখারি : ১১৯০]
কোন কোন বর্ণনায় অবশ্য পঞ্চাশ হাজার রাকাতের কথাও আছে। আর সে নামাযটি যদি রাসূলুল্লাহ সা.-এর পেছনে পড়া হয়! এ জন্যেই হয়তো সে নারী সাহাবি মসজিদে নববীতে এসে নামায পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু এতসব ফযীলত থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর রাসূল তাকে বললেন, নারীদের জন্যে এ মসজিদে এসে নামায পড়ার তুলনায় নিজ মহল্লার মসজিদে, নিজ মহল্লার মসজিদের তুলনায় বাড়ির উঠানে, উঠানের তুলনায় ঘরে, ঘরের তুলনায় ঘরের কোন ছোট নির্জন কক্ষে নামায পড়া উত্তম।
রাসূলুল্লাহ সা. নারীদেরকে মসজিদে আসতে যদিও নিষেধ করেননি; আবার তিনি তাদেরকে মসজিদে আসতে উৎসাহিতও করেননি। বরং নিরুৎসাহিত করেছেন। হাদীস শরীফে আছে, ঘরের কোণে আদায় করা নামাযই হচ্ছে নারীদের শ্রেষ্ঠ নামায। কিন্তু সাহাবিদের যুগে এসেই তাঁদের কেউ কেউ জামাতে নারীদেরকে অংশগ্রহণ না করার প্রতি জোর দিয়েছেন। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. ও উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকী রা. বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হযরত আয়েশা রা. স্পষ্টই বলেছেনÑ রাসূলুল্লাহ সা. যদি দেখতেন বর্তমান নারীদের অবস্থা, তাহলে অবশ্যই তাদেরকে মসজিদে আসতে বারণ করতেন, যেমনটি করা হয়েছিল বনি ইসরাঈলের নারীদের সাথে। [মুসলিম শরীফ : ১০২৭]
রাসূলুল্লাহ সা.-এর যুগের পর সাহাবিদের যুগই হচ্ছে ‘খায়রুল কুরূন’ তথা শ্রেষ্ঠতম যুগ। অথচ সে যুগের নারীদের সম্পর্কেই হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলছেন, তাদের অবস্থা যদি আল্লাহর রাসূল দেখতেন, তাহলে অবশ্যই তাদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দিতেন। সাহাবিযুগের নারীদের যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে চৌদ্দ শতক পরের বর্তমান কালের নারীদের সম্পর্কে আর কী-ই বা বলা যায়!
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন- নারী তো পর্দাযোগ্য। যখন সে তার ঘরের কোণে অবস্থান করে তখনই সে তার প্রভুর সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। আর যখন বের হয় তখন শয়তান তাকে উঁকি দিয়ে দেখতে চায়। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা : ৭৬৯৮]
হযরত আবু উমর শায়বানী রহ. বলেন, আমি হযরত ইবনে মাসউদ রা.কে দেখেছি, তিনি জুমার দিন মহিলাদেরকে মসজিদ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। [প্রাগুক্ত : ৭৬৯৯]
তাবেয়ী হযরত ইবরাহীম নাখায়ী রহ.-এর তিন স্ত্রী ছিল। কিন্তু তিনি তাদের কাউকেই জামাতের সাথে কোন নামায পড়তে দিতেন না। [প্রাগুক্ত : ৭৭০৩]
সাহাবি ও তাবেয়ীযুগ পরবর্তী মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কেরামও এ মতই পোষণ করেছেন। তাঁদের কেউই মহিলাদেরকে কোন ধরণের শর্তারোপ করা ছাড়াই মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দেননি। যেমন, মুসলিম শরীফের ব্যখ্যাকার আল্লামা নববী রহ. বলেনÑ ‘এ ধরণের (অর্থাৎ মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দিয়ো না) হাদীসগুলো থেকে বাহ্যত প্রতীয়মান হয়, তাদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দেওয়া যাবে না। কিন্তু উলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে কতগুলো শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন, যেগুলো হাদীস থেকেই গৃহীত। যেমন, সুগন্ধি ব্যবহার না করা, সাজ-গোজ করে বের না হওয়া, আওয়াজ শোনা যায় এমন কোন অলংকার কিংবা কোন দামী কাপড় পরিধান না করা, পুরুষের সাথে মিলেমিশে একাকার না হয়ে যাওয়া, যুবতী না হওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ এমন সব বিষয় থেকে মুক্ত থাকা যাতে ফেতনায় পড়ার আশংকা থাকে। এরই সাথে রাস্তায়ও আশংকামূলক কিছু না থাকা।’
ফুকাহায়ে কেরামও প্রথমে শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে যখন সবগুলো শর্ত পাওয়া দুষ্কর হয়ে গেলো, বিশেষ করে ফেতনার আশংকা খুবই বেড়ে গেলো, তখন তারা সে অনুমতির পরিবর্তে মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করেছেন। যেমন, হানাফী মাযহাবের প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘হিদায়া’র ভাষ্যÑ ফেতনার আশংকার কারণে যুবতী নারীদের জন্যে জামাতে উপস্থিতি মাকরূহ। কিন্তু বৃদ্ধাদের জন্যে ফজর মাগরিব ও ইশার জামাতে শরিক হতে কোন সমস্যা নেই। এটা ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর অভিমত। আর ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ রহ. এর মতে, বৃদ্ধ মহিলাগণ সব নামাযেই বের হতে পারবে। কেননা, তাদের ক্ষেত্রে ফেতনার আশংকা নেই, তাই তাদের জন্যে তা মাকরূহও নয়।
কিন্তু পরবর্তীতে যুবতী ও বৃদ্ধাদের মাঝে এ বিভাজন আর রক্ষা করা হয়নি। বরং নারীদের সবাইকেই মসজিদে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। বিখ্যাত ফতোয়াগ্রন্থ ‘ফতোয়ায়ে শামী’ তে আছে, ‘নারীদের সবার জন্যে সর্বাবস্থায় মসজিদে যাওয়া মাকরূহ, এমনকি বৃদ্ধা হলেও এবং রাতের বেলায়ও। পরবর্তী ফকীহগণের এটাই মত।’
হাদীসগ্রন্থ ‘ই’লাউস সুনানে’র রচয়িতা হযরত যফর আহমদ উসমানী রহ. এ মতটিই উল্লেখ করেছেন।
সবশেষে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ফেতনা-ফাসাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে মসজিদের ভেতরে পূর্ণ শরয়ী পর্দার ব্যবস্থা থাকলেও মহিলাদের জন্যে মসজিদে নামায পড়তে যাওয়া জায়েয নয়; বরং তারা তাদের ঘরেই নামায পড়বে। হ্যাঁ, যদি কোন প্রয়োজনে তারা বাইরে বের হয় এবং ঘরে ফিরে নামাযের সময় না পাওয়ার আশংকা থাকে, তাহলে তখন তারা পর্দার সাথে মসজিদে নামায আদায় করতে পারেন। আর এজন্যে মসজিদগুলোতে বিশেষত হাসপাতাল রেলস্টেশন বাসস্ট্যান্ডের মসজিদ ও হাইওয়ের পাশের মসজিদে মহিলাদের নামাযের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা রাখা উচিত। সফরের অজুহাতে নামায কাযা করা কিছুতেই জায়েয হবে না।
নেট থেকে সংগৃহীত।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষক- জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া ঢাকা।