জলবসন্ত (ইংরেজি: Chickenpox) একধরনের অত্যন্ত সংক্রামক ব্যাধি। ভ্যারিসেলা জুস্টার ভাইরাস(ইংরেজি:varicella zoster virus) নামক একপ্রকার ভাইরাস দ্বারা এই রোগ সংঘটিত এবং সংক্রামিত হয়ে থাকে।গরম শুরু হওয়ার সাথে সাথে অস্বস্তিকর পরিবেশের পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। চিকেনপক্স, হাম জাতীয় অসুখ-বিসুখ তাদের আগমন বার্তা জানানো শুরু করেছে। সেজন্য ভীষণ রকম ছোঁয়াচে এই রোগগুলো থেকে আমাদের সতর্ক ও সাবধান হতে হবে। এই মৌসুমে যেসব রোগ সবচেয়ে বেশি হতে দেখা যায় তার মধ্যে চিকেনপক্স বা জলবসন্ত অন্যতম। শীতের শেষে ও বসন্ত ঋতুতে এই রোগ বেশি হতে দেখা যায়। চিকেনপক্স বা জলবসন্ত কি ভেরিসেলা জোস্টার নামক এক ধরনের ভাইরাস দিয়ে এই রোগ সংক্রমিত হয়। অত্যন্ত ছোঁয়াচে এই রোগ গরমের দিনে বেশি হয়।
নারী- পুরুষ যে কারো যে কোনো বয়সে পক্স হতে পারে। তবে শিশুদের অর্থাৎ ১০ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এই রোগ বেশি হতে দেখা যায়।
যেভাবে এই রোগ ছড়ায় চিকেনপক্সঃ সাধারণত ১. আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশির মধ্য দিয়ে ছড়ায়, ২. চিকেনপক্সের ফলে সৃষ্ট ফোসকা ফেটে গিয়ে যে পদার্থ নির্গত হয় তা অন্যের সংস্পর্শে এলে এই রোগ সংক্রমিত হতে পারে। ভাইরাস দেহে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই উপসর্গ দেখা যায় না। রোগটির সুপ্তিকাল ২ থেকে ৩ সপ্তাহ। তবে সাধারণত জীবাণু দেহে প্রবেশের ৮-১০ দিনের মধ্যে কিছু না কিছু লক্ষণ দেখা যায়। লক্ষণ প্রথমে সমস্ত শরীরে ব্যথা ও অস্বস্তি হয়ে থাকে। তারপর জ্বর, দানা বা ফোসকা হয়- জ্বর ১০০০ থেকে ১০১০ বা ১০২০ পর্যন্ত উঠতে পারে। দানা বা ফোসকা প্রথমে মুখে, বুকে, গলায় ও পিঠে দেখা যায়, আকারেও ছোট থাকে। পরে শরীরের বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়ে। দানাগুলোও আকৃতিতে একটু বড় হয় এবং তার ভেতরে পানি জাতীয় পদার্থ জমে ফোসকারীর মতো দেখা যায়। এই পানি ভাইরাস দ্বারা পূর্ণ থাকে। বাদামি রঙের এই ফোসকা পরবর্তীতে কি ছুটা কালছে বর্ণ ধারণ করে। দানা কারো ক্ষেত্রে কম কারো ক্ষেত্রে বেশি হ তে পারে। শরীরে ব্যথার সাথে চুলকানিও থাকতে পারে। পক্স অনেক সময় ভেতরে হতে দেখা যায়। তখন গলায় ব্যথা হয়, ঢোক গিলতে ও খাবার খেতে খুব কষ্ট হয়।
চিকিৎসা
ভাইরাস ইনফেকশন এই চিকেনপক্সের কোনো চিকিৎসা নেই। উপসর্গ অনুযায়ী এই রোগের চিকিৎসা নেই। উপসর্গ অনুযায়ী এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল সাসপেনশন খাওয়ানোই ভালো। সিরাপের চেয়ে সাসপেনশন নিরাপদ। কারণ এটা তৈরিতে ডাই- ইথিলিন গ্লাইকল নামক উপাদান-এর প্রয়োজন হয় না, যেটা কিনা সিরাপ তৈরিতে প্রয়োজন হয়। ভালো কোম্পানির সাসপেনশন নিশ্চিন্তে খাওয়ানো যায়।চুলকানির জন্য এন্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। এই ওষুধগুলো ট্যাবলেট ও সিরাপ দুই ভাবেই পাওয়া যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে সিরাপ বেশি উপযোগী। এই রোগ থেকে অন্য কোনো ইনফেকশন বা সংক্রমণ যাতে না হয় সেজন্য এন্টিবায়োটিক খাওয়া যেতে পারে, তবে তা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে। ৫-৭ দিনের মধ্যে ফোসকাগুলো শুকা তে আরম্ভ করে। শুুকানোর পর আক্রান্ত চামড়া পড়ে যায়। এই সময়টাতে সবচেয়ে বেশি রোগ সংক্রমিত হয়। কারণ পড়ে যাওয়া চামড়া থেকে ভাইরাস ছড়ায়। তাই অবশ্যই খেয়াল রাখা প্রয়োজন যাতে করে আক্রান্ত চামড়া যেখানে সেখানে না পড়ে। চোখের ভেতরে পক্স হলে চোখে ইনফেকশন হয়ে চোখের সাদা অংশ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনেকের ধারণা, এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে দানা ওঠা বন্ধ হয়ে যায় এবং পরে আবার চিকেনপক্স হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। যার একবার জলবসন্ত হয়ে থাকে, তার জীবনে আর এই রোগ হওয়ার ভয় থাকে না। কারণ তার শরীরে চিকেনপক্স এর আজীবন প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। রোগীর খাবার এই সময়ে রোগী সব ধরনের স্বাভাবিক খাবারই খেতে পারবে। তবে এলার্জি যাতে না হয় সেজন্য সেইসব খাবার যেমন ডিম, বেগুন, ইলিশ মাছ, গরুর গোশত, চিংড়ি মাছ রোগীকে না দেওয়াই ভালো। তাছাড়া এ সময় রোগীর এমনিতেই চুলকানি হয়ে থাকে। দুধ, মুরগির গোশত, স্যুপ, ফল-মূল, শাক- সবজি এসব খাবার রোগীকে পরিমিতভাবে খাওয়াতে হবে।
সতর্কতাঃ যেহেতু এই রোগ অত্যন্ত ছোঁয়াচে তাই রোগীকে আলাদা করে মশারি টাঙিয়ে রাখতে হবে। রোগীর ব্যবহার্য সমস্ত দ্রব্য যেমন- প্লেট, গ্লাস, কাপড়, তোয়ালে, বিছানার চাদর, বালিশের কভার সমস্ত একদিকে যেমন আলাদা রাখতে হবে। তেমনি নিয়মিত গরম পানি ও স্যাভলন দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। দানাগুলো যাতে নখ দিয়ে না চুলকায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এতে করে দাগ হতে পারে। এ সময় গোসল না করিয়ে প্রথমে ভিজে তারপর শুকনো তোয়ালে দিয়ে খুব সাবধানে রোগীর গা মুছিয়ে দিতে হবে, যাতে গুটিতে ছোঁয়া না লাগে। যদিও পক্সের দাগ কিছুদিন পর আপনা আপনি মিলিয়ে যায়, তবুও সুস্থ হয়ে যাবার পর দাগের জায়গাগুলোতে কোনো ভালো ক্রিম বা লোশন লাগালে আরাম ও উপকার দুই-পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত সেবা এই রোগের আসল চিকিৎসা।
জটিলতাঃ চিকেনপক্স আক্রান্ত ব্যক্তি বা শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি খুবই কম। যেটুকু আছে তাও সাধারণত শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি হতে দেখা যায় এবং সেটাও পক্সের জটিলতার কারণে। পক্স থেকে শিশু ও কিশোররা অনেক সময় যে সকল জটিলতায় ভুগে থাকে সেগুলো হচ্ছে নিউমোনিয়া , মায়োকার্ডইটিস (হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশির সমস্যা) , গ্লোমেরু লোনেফরাইটিস (কিডনির সমস্যা) , এনকেফালাইটিস (মস্তিষ্কের সমস্যা) প্রতিরোধ চিকেনপক্স প্রতিরোধের জন্য কোনো প্রতিষেধক বা টিকা এখনো নেই। তাই আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকতে হবে। রোগীকে বাড়িতে আলাদা করা সম্ভব না হলে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে সতর্ক বেশি হতে হবে। যারা আক্রান্ত তাদের প্রতি কোনো বিশেষ যত্ন নিতে হবে আর যারা সুস্থ আছে তাদেরকে আক্রান্ তদের থেকে দূরে রাখতে হবে। কারণ শিশুরা খুব সহজেই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে
জলবসন্ত নিয়ে বিভ্রান্তি
জলবসন্ত গুটিবসন্তের মতো প্রাণসংহারী রোগ না হলেও রোগটি নিয়ে জনমনে নানা ধরনের কুসংস্কার ছাড়াও ভীতি রয়েছে। একবার কোনো পরিবারে বসন্ত দেখা দিলে তাদের আশপাশে এমনকি সেবার জন্যও লোকজন খুঁজে পাওয়া যায় না। জলবসন্ত অত্যন্ত ছোঁয়াচে হলেও রোগীর সংস্পর্শে এলেই যে তা নিশ্চিত ছড়িয়ে পড়বে- এ ধারণাটি কিন্তু মোটেও ঠিক নয়। জলবসন্ত সাধারণত রোগীর একেবারে সংস্পর্শে এলে তার কফ, শ্বাস-প্রশাসের সাথে নির্গত হওয়া জীবাণু অথবা বসন্তের কারণে সৃষ্ট ক্ষতের নিবিড় সংস্পর্শে রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্য সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক ও সেবীরা এসব রোগীর মুখে মাস্ক বা কাপড় বেঁধে সেবাদান করে থাকেন। অনেকের আবার ধারণা, ত্বকের ওপর সৃষ্ট শুকনো খোসাগুলো রোগের উৎস। সুতরাং এদের পুড়িয়ে ফেলতে হবে। অথচ সত্যটি হলো, ত্বকের ক্ষত কাঁচা অবস্থাতেই রোগটি সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা সর্বাধিক। অনেকের ধারণা, পক্স হলেই দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। এ ধারণাটিও ঠিক নয়। বরং যাদের একবার ভেরিমেলা বা চিকেনপক্স দেখা দিয়েছে হারপিস রোগীর সংস্পর্শে এলে তাদের অপেক্ষাকৃত মারাত্মক হারপিসজনিত ভাইরাসের রোগে শিকার হতে হয়। এ ছাড়া পুষ্টিহীনতা, এইডস ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেলে একাধিকবার রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেকেই জলবসন্ত হলে মাছ, ডাল, গোশত এসব খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেন, পাছে বসন্তের ক্ষত যেন না বেড়ে যায়। এ ধারণাটিও অমূলক। পক্সে আক্রান্ত রোগীর জন্য সব খাবার উন্মুক্ত। তবে মুখের তালু ও অভ্যন্তরে পক্সের গুটি দেখা দেয়ায় এ সময় ঝালযুক্ত খাবার না খাওয়ানোই শ্রেয়। পক্সের দাগ বা ক্ষতের চিহ্ন কমানোর কারণে অনেকেই ডাবের পানি দিয়ে গোসল করে থাকেন। এ ধরনের কোনো চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত নয়। জলবসন্ত দেখা দিলে ত্বকের ক্ষতটি কোনোক্রমেই চুলকানো যাবে না। এজন্য চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে প্রয়োজনে এন্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ সেবন করতে হবে। ক্ষতটি যেন ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে পেকে না যায় সে কারণে ক্ষতের ওপর প্রয়োজনে ক্যালামিন লোশন বা এন্টি ব্যাকটেরিয়াল দ্রবণের প্রলেপ দেয়া যেতে পারে। জলবসন্ত সাধারণত ছোঁয়াচে রোগমাত্র। তবে অবহেলা করলে এ রোগ থেকেও অন্ধত্ব ও স্নায়ুবিক দুর্বলতা থেকে জীবনহানি ঘটতে পারে। সুতরাং জলবসন্তের সময় নিজেকে নিরাপদে সরিয়ে রাখা, আক্রান্ত শিশু বা শিক্ষার্থীদের শিক্ষায়তনে না পাঠানো এবং আক্রান্ত হলে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণসহ পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিলে রোগটি আপনা আপনি ভালো হয়ে যায়।
নেট থেকে সংগৃহীত- সুত্রঃ