হযরত ইমাম মাহদী (আ.
ফা.) ইমামিয়া শিয়াদের দ্বাদশ ইমাম এবং হযরত ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর একমাত্র
সন্তান। ইমামিয়া শিয়ারা সকলেই ইমাম মাহদী (আ. ফা.) এর প্রতি এ বিশ্বাস
পোষণ করে যে, তিনি জীবিত এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছেন; তিনি আশার শেষ আলো এবং মানবজাতির পরিত্রাণ দাতা
বলে তারা বিশ্বাসী। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর শরণাপন্ন হয় এবং তার
আগমনের অপেক্ষায় প্রহর গুনে। আর ততদিন পর্যন্ত এ বিষয়টি অব্যাহত থাকবে যতদিন না
মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর আবির্ভাব ঘটে। মহান আল্লাহর
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি পৃথিবীকে ন্যায়নিষ্ঠতা ও ন্যায় বিচারে পূর্ণ করবেন ও ইসলামি
শরিয়তকে সমাজ পূনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন এবং আল্লাহর হুকুম-আহকামের পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবায়ন ঘটাবেন।
তিনি মহানবী হযরত
মুহাম্মাদ (স.) এর সমনামের অধিকারী। শিয়া রেওয়ায়েত সমূহে
তার নাম
উল্লেখ করার বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে। অধিকাংশ শিয়া
ওলামাই তার নামকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননা। যদিও এ রেওয়ায়েত
তাঁর শৈশবকাল ও অন্তর্ধানের পূর্বের সাথে সম্পৃক্ত –যাতে শত্রুরা তাঁকে চিহ্নিত করে তার ক্ষতিসাধন না করতে পারে- কিন্তু
তা সত্ত্বেও মাহদী, হুজ্জাত, কায়েম, মুন্তাযার, বাকিয়াতুল্লাহ, ইমামে যামান, ওয়ালি আসর, ইমামে আসর ইত্যাদি উপাধির মাধ্যমে তাকে স্মরণ করা হয় অথবা ‘আল-হাদ্বরাহ’, ‘আল-নাহিয়াহ আল-মুকাদ্দাসাহ’, ‘আল-গারীম’ ইত্যাদি কুনিয়াহ’র মাধ্যমে।
তিনি ২৫৫ হিজরী’র ১৫ই শাবান তথা
আব্বাসীয় খলিফা আল-মুহতাদী’র খেলাফত সময় শেষ হওয়ার ১৫ বা ১৬ দিন পর জন্মলাভ করেন। তাঁর
মাতা উম্মে ওয়ালাদ ছিলেন রোমীয়, যার নাম ছিল নারজিস এবং অপর এক বর্ণনার ভিত্তিতে মালিকাহ। তাকে
রোমের সেজারের
(সম্রাটে’র) দৌহিত্রী বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। আর
এ মহিয়সী’র সাথে ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর বিবাহের বিষয়ে, ইমাম (আ.) এর জন্ম
এবং তাঁর হতে যে সকল মোজেযা পরিলক্ষিত হয়েছে সে সকল বিষয়ে অনেক রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে।
জন্মের পর হতে ইমাম (আ.)
কে লোক চক্ষুর অন্তরালে রাখা হত। কিন্তু ইমাম
পরিবারের কিছু কিছু সদস্য অথবা ইমামের বিশেষ কিছু সাহাবীগণ তাঁকে দর্শনে সক্ষম হয়েছেন এবং এ সময়
ইমাম (আ.) তাঁর শীঘ্রই আগত অন্তর্ধান সম্পর্কে তাদেরকে অবগত করেছিলেন।
তার অবয়বের বর্ণনা দিতে
গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি চেহারা ও আচরণের দিক থেকে আল্লাহর রাসূল (স.) এর সাদৃশ্য। তার
চেহার হচ্ছে উজ্জ্বল এবং তার ডান চিবুকে রয়েছে একটি কালো তিল, দাঁতগুলো পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন এবং তার চেহারায় একটি বিশেষ
চিহ্ন রয়েছে...
সর্বশেষ প্রকাশ্যে ইমামকে
দেখা যায় ২৬০ হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসে যখন তিনি স্বীয় পিতার জানাযার
নামায আদায়ের জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন। আর তার অন্তর্ধানের
যুগ তারপর
হতে শুরু হয়।
শিয়া রেওয়ায়েতসমূহের
ভিত্তিতে ইমাম মাহদী (আ. ফা.) এর জন্য রয়েছে দু’টি গায়বাত তথা অন্তর্ধান; স্বল্পমেয়াদী ও
দীর্ঘমেয়াদী। স্বল্পমেয়াদী অন্তর্ধানের সময়কাল ছিল ৭৪ বছর। তিনি
এ সময় তার চারজন নায়েব বা প্রতিনিধির মাধ্যমে নিজের পত্র ও বিশেষ বার্তাকে জনগণের নিকট পৌঁছাতেন
আর নিজে তাদের (প্রতিনিধিদের) সাথে সাক্ষাতের জন্য আসতেন আর এ ৪ জন প্রতিনিধি হলেন :
(১) আবু আমর উসমান বিন
সাঈদ বিন আমর আমরি আসাদী আসকারী : তিনি ছিলেন ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী
(আলাইহিমাস সালাম) এর সাহাবী এবং একাদশ ইমাম হযরত হাসান আসকারী (আ.) এর
গোসল, কাফন
ও দাফনের কার্যক্রমে তাঁর ওসিয়ত মোতাবেক উসমান বিন সাঈদ আঞ্জাম দেন। তিনি
ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর নির্দেশ মত ইমাম মাহদী (আ. ফা.) এর পেশকারের দায়িত্ব নেন এবং যতদিন
জীবিত ছিলেন ততদিন এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
(২) আবু জাফার
মুহাম্মাদ বিন উসমান বিন সাঈদ : তিনি ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর যুগে স্বীয় পিতার
সহকারী ছিলেন এবং পিতার মৃত্যুর পর ইমাম (আ.) এর প্রতিনিধি ও
নায়েবের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তিনি ফিকাহ শাস্ত্র
বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন, যেগুলোকে তিনি একাদশ এবং দ্বাদশ ইমাম (আ.) হতে শুনে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ‘আল-আশরাবাহ’ গ্রন্থটি সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। আবু জাফার ৩০৪ বা ৩০৫ হিজরীতে
জমাদিউল আওয়াল মাসের শেষ দিন বাগদাদে ইন্তিকাল করেন এবং সেখানেই তাকে
দাফন করা হয়। তিনি প্রায় ৫০ বছর যাবত ইমাম (আ. ফা.) এর নায়েব ও পেশকার
হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
(৩) আবুল কাসেম হুসাইন
বিন রুহ বিন আবি বাহর নৌবাখতি : আবু জাফার মুহাম্মাদ বিন উসমান তার
মৃত্যুর দুই বছর পূর্বে শিয়া ব্যক্তিদেরকে একত্রিত করে হুসাইন বিন রুহকে –যিনি দীর্ঘ সময়
যাবত তার সহকারী’র দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং তার বিশ্বস্ত ছিলেন- নিজের স্থলাভিষিক্ত
হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। হুসাইন বিন রুহ ছিলেন তত্কালীন সময়ের প্রখ্যাত
শিয়া আলেমদের একজন। তিনি ৩২৬ হিজরী’র শাবান মাসে বাগদাদে ইন্তিকাল করেন এবং
নৌবাখতিয়াহ কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
(৪) আবুল হাসান আলী বিন
মুহাম্মাদ সামারী : যুগের ইমাম (আ. ফা.) এর নির্দেশ ও হুসাইন বিন রুহে’র ওসিয়ত মোতাবেক তিনি
ইমাম (আ.) এর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি প্রায় দুই বছর
যাবত ইমাম (আ.) ও শিয়াদের মাঝে মাধ্যম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর
৩২৮ বা ৩২৯ হিজরী’র শাবান মাসে বাগদাদে ইন্তিকাল করেন। আর সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। তার
মৃত্যুর মধ্য দিয়ে স্বল্পমেয়াদী অন্তর্ধান ও বিশেষ প্রতিনিধিগণের যুগের সমাপ্তি ঘটে এবং দীর্ঘমেয়াদী
অন্তর্ধানের যুগ শুরু হয়।
ইমাম (আ.) আবুল হাসান আলী
বিন মুহাম্মাদ সামারিকে সর্বশেষ যে পত্র ও নির্দেশ দিয়েছিলেন তা ছিল
এরূপ : ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। হে আলী বিন
মুহাম্মাদ সামারী মহান আল্লাহ তোমার [বিয়োগের] মুসিবতের কারণে তোমার ভাইদের পুরস্কারকে আরো বৃহৎ করুন। তুমি
৬ দিন পর মৃত্যুবরণ করবে। অতএব, নিজেকে প্রস্তুত কর এবং কাউকে নিজের স্থলাভিষিক্ত
হিসেবে ওসিয়ত করো না। কেননা পূর্ণ (দীর্ঘমেয়াদী) অন্তর্ধানের যুগ
শুরু হবে এবং এরপর মহান আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত আর কোন যুহুর (আবির্ভাব)
ঘটবে না। আর সে আবির্ভাবটি হবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর, যখন অন্তরসমূহ কঠোর
হয়ে যাবে এবং পৃথিবী অন্যায় ও অত্যাচারে পরিপূর্ণ হবে। এ
বিষয়টি অতি শীঘ্রই ঘটবে যে, শিয়াদের মধ্য হতে কেউ কেউ আমার সাথে সাক্ষাতের দাবী করবে; সুফিয়ানের খুরুজের
(আবির্ভাবে’র) পর এবং আসমানী বিকট চিত্কারের পূর্বে এ ধরণের দাবী যে করবে সে মিথ্যাবাদী এবং অপবাদদানকারী। লা হাওলা ওয়া লা
কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযিম’।
ইমাম (আ.) এর
স্বল্পমেয়াদী অন্তর্ধানের যুগে তার চারজন প্রতিনিধি ব্যতীত অন্যান্য কিছু
বিশেষ ব্যক্তিত্বও তাঁর সাক্ষাত লাভে সক্ষম হয়েছেন। আবার
কেউ কেউ
ছিল যারা তার প্রতিনিধি ও বাবিয়্যাতের মিথ্যা দাবী তুলে শিয়াদের কঠোর অভিসম্পাতের
মুখোমুখি হয়েছে, তাদের মধ্যে শারিয়ী, নুমাইরী, হুসাইন হাল্লাজ এবং শালমাগানী উল্লেখযোগ্য।
আলী ইবনে মুহাম্মাদ
সামারী’র মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইমাম (আ.) এর বিশেষ প্রতিনিধিগণের
যুগের সমাপ্তি ঘটে এবং তার সাধারণ প্রতিনিধিদের যুগ শুরু হয়। এই অর্থে যে, ইমাম (আ.) বিশেষ কিছু শর্ত নির্ধারণ করেছেন, প্রতিটি যুগে ইমাম (আ.) কর্তৃক
নির্ধারিত ঐ সকল শর্তের অধিকারী ব্যক্তিত্বের অনুসরণ করা ওয়াজিব এবং তার
বিরোধিতা করা হারাম। যুক্তি হিসেবে এক্ষেত্রে অসংখ্য রেওয়ায়েত উল্লেখ
করা হয়েছে যার মধ্য হতে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল :
(১) প্রখ্যাত শিয়া আলেম
ইসহাক বিন ইয়াকুব কুলাইনী (রহ.), ইমাম (আ.) এর দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ধানের যুগে শিয়াদের কর্তব্যের বিষয়ে ইমাম (আ.) এর নিকট প্রশ্ন করলে তাঁর
হতে নিম্নের তাওকী’ তথা উত্তরপত্র তিনি লাভ করেন : ‘...ঘটিত সকল বিষয়ে
তোমরা অবশ্যই আমাদের রাবীদের (রেওয়ায়েত বর্ণনাকারীদের) শরণাপন্ন হবে। এরা
হচ্ছে আমার পক্ষ হতে তোমাদের উপর হুজ্জাত এবং আমি হচ্ছি মহান আল্লাহর পক্ষ
হতে তোমাদের সকলের জন্য হুজ্জাত’।
(২) ইমাম হাসান
আসকারী (আ.) এর সাথে সম্পৃক্ত তাফসীর গ্রন্থে ((و منهم أمیون لا یعلمون الکتاب))[সূরা বাকারাহ : ৭৮]-এ
আয়াতের তাফসীরে ওলামাদের সম্পর্কে বলেছেন : ফকীহদের মধ্যে যারা নিজেদের
প্রবৃত্তির উপর কর্তৃত্বশীল হবে, নিজের দ্বীনকে রক্ষা করবে, নিজের নফসের কুমন্ত্রণার বিরোধিতা করবে এবং মহান
আল্লাহর নির্দেশ পালন করবে, সকলের উপর ওয়াজিব হচ্ছে তার তাক্বলিদ বা অনুসরণ করা।
(৩) কুলাইনী, সাদুক ও তুসি (রহ.), ইমাম সাদিক (আ.)
হতে একটি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন যা ‘হাদীসে মাকবুলাহ উমার বিন হানযালাহ’ নামে প্রসিদ্ধ : ‘...তোমাদের মধ্য হতে
যে ব্যক্তিই আমাদের হাদীস বর্ণনা করবে, হালাল ও হারাম সম্পর্কে জ্ঞান রাখবে এবং আমাদের আহকাম সম্পর্কে
অবগত তাকে তোমাদের শাসক হিসেবে নির্বাচিত কর, কেননা আমি তাকে তোমাদের শাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি...।’
(৪) মহানবী (স.)
বলেছেন : ‘আমার উম্মতের আলেমরা, বনি ইসরাইলের নবীদের ন্যায়’। অর্থাৎ যেভাবে বনি
ইসরাইলের নবীগণ (আ.) হযরত মুসা (আ.) এর আনীত দ্বীনের রক্ষক ছিলেন এবং তাদের
অনুসরণ করা বনি ইসরাইলের জন্য অপরিহার্য একটি বিষয় ছিল, মুসলিম উম্মাহ’র ওলামারাও মহানবী
(স.) এর ধর্মের রক্ষক এবং শরিয়তের হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করা ওয়াজিব।#
[সূত্র : (abna) নেট থেকে সংগৃহিত]